April 20, 2025 | Sunday | 6:20 AM

বট গাছের নীচে হোমযজ্ঞ অকাল দুর্গোৎসবে

0

অভিজিৎ হাজরা#আমতা #হাওড়া :-
রাজ্যবাসী যখন বাগদেবীর আরাধনায় রত,সেই মুহূর্তে হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুর বিধান সভা তথা আমতা১ নং ব্লকের আমতা থানার খোশালপুর গ্ৰাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত কুরিট গ্ৰামের গ্ৰামবাসী মেতে উঠেছে ৪১ তম বার্ষিক দশভূজা কাত্যায়নী দুর্গাপূজায়।
অকাল দুর্গোৎসব প্রাঙ্গনে বিশালাকৃতি সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ। পাশেই তারাময়ী আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা গৌরচন্দ্র হাজরার সমাধি। বটগাছের তলায় মন্ত্রপূত ত্রিশূলের সামনে তিনি তন্ত্র- সাধনায় বসতেন। বুধবার সেখানেই প্রকান্ড হোমকুন্ডে চলছে হোমযজ্ঞ। মহানবমী পুজোর শেষপর্বে উচ্চারিত হচ্ছে বৈদিক মন্ত্র। একটি করে সমিধ ও ঘৃতাহুতি তে উজ্জ্বল পবিত্র হোম শিখার দীপ্তি।পোহাল নবমী নিশি। বেজেছে বিদায়ের সুর।রাত পোহালেই বিজয়া। বিসর্জনের বিষাদ। হাওড়ার আমতা কুরিট গ্ৰামের অকাল দুর্গোৎসব সাঙ্গ। তবু একটু আনন্দ নিহিত থাকছে কাত্যায়নী মেলাকে কেন্দ্র করে আর ও চারদিন।”করোনা ” স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এই মেলা চলছে। পূজা ও মেলার উদ্যোক্তারা সহ স্বেচ্ছাসেবক-স্বেচ্ছাসেবিকাবৃন্দ “করোনা “সচেতনতা বার্তা দিচ্ছেন,মাক্স বিতরণ করছেন।
এদিন সকাল থেকেই মন্ডপে ভিড় উপচে পড়ছে।কুরিট সহ প্রতিবেশী বড়মহড়া,চাকপোতা,খোশালপুর,কোটালপাড়া,ছোটমহড়া,মল্লগ্ৰাম, সোমেশ্বর এমনকি হাওড়ার দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ভিড় জমিয়েছেন। মায়ের পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছেন।শস্যের প্রার্থনার সঙ্গে মহামারী “করোনা” দূরিকরণের সঙ্গে বিশ্বশান্তির আর্জি জানিয়েছেন মহালক্ষ্মী কাত্যায়নীর কাছে।বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হোমযজ্ঞ দেখতে ভক্তকূল আকূল হয়েছেন। দুপুর ১ নাগাদ শুরু হয়েছে হোমযজ্ঞ, মূল মন্ডপ থেকে ৫০ ফুট দূরে প্রকান্ড বটবৃক্ষ তলায়। একপাশে সাজানো ফুলের বাগান।অন্যধারে তারামায়ের মন্দির।পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ডি-২ ক্যানেল। শস্যের প্রার্থনায় এলাকাবাসীর দুভিক্ষ ঘোচাতে,দুর্দশা দূর করতে দেবী কাত্যায়নীর আবাহন করা হয়েছিল আজ থেকে ৪৯ বছর আগে কুরিট গ্ৰামে। তারপর ওই খালের জলেই খরা কেটে চাষাবাদ শুরু হয়েছিল।
শস্যহানির বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত হয়েছিল কুরিট সহ পার্শ্ববর্তী অনেক গ্ৰাম। সেই থেকেই কাত্যায়নীর আরাধনায় নিবেদিত প্রাণ উত্তম কোলে, জয়দেব কোলে,
প্রিয়তোষ কাঁড়ার ও সুকুমার বাবুরা।গ্ৰামবাসীদের ভক্তিভরে দেওয়া স্বেচ্ছাদানে তাঁরা এই পূজা করেন। পূজার ক’ দিন রাস্তার ধারে দু’চারজন মেলায় আসা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে স্বেচ্ছাদান গ্ৰহণ করেন। খুশি করে যা দিয়ে যান দর্শনার্থীরা,তা নিয়েই সন্তুষ্ট তারাময়ী আশ্রমের সদস্যরা। কয়েক দিন পরেই অন্নপূর্ণা পূজা।সেই পূজায় অন্নকূট উৎসবে গ্ৰামবাসীরা নারায়ণ সেবার আয়োজন করে এই মঠেই।মঠের একাধারে রয়েছে কালী মন্দির ও। সেখানে কালীপূজা ও হয়। মূলত এই তিন মাতৃশক্তির পূজা হয় আশ্রমে।
এই পূজা প্রসঙ্গে পূজার অন্যতম উদ্যোক্তা উত্তম কোলে বলেন, আমার পূর্বপুরুষরা যা দেখেছে তা শুনেছি যে ” তারাময়ী আশ্রম” যেখানে প্রতিষ্ঠিত আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে এই স্থানটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। শিয়াল, কুকুর সহ বিষধর সাপের আস্তানা ছিল। বড়মহড়া গ্ৰামনিবাসী তারামা ভক্ত বিশ্বনাথ হাজরা সাধনায় সিদ্ধলাভ করার জন্য ওনার গুরুদেবের সঙ্গে আলোচনা করে এই জঙ্গলে আসেন সাধনা করতে।সাধনা করার জন্য পঞ্চমুন্ডি আসনের প্রয়োজন।পঞ্চমুন্ডি আসন করার জন্য শিমুল,বেল,নিম,বট, পিপুল এই পাঁচটি গাছের যে কোন একটি গাছের নীচে আসন তৈরী করতে হয়। বিশ্বনাথ হাজরা এই জঙ্গলের একটি বট গাছ কে বেছে নেন সাধনার জন্য পঞ্চমুন্ডি আসন নির্মাণে।বিশ্বনাথ হাজরা পঞ্চমুন্ডি আসনের জন্য একটি অপঘাতে মৃত্যু চন্ডালের মাথা, একটি বিষধর সাপ(কেউটে/গোখরো)এর মাথা, একটি বেজি বা নেউলে এর মাথা, একটি শৃগালের মাথাও একটি হনুমানের মাথা জোগাড় করেন। অমাবস্যা তিথিতে রাত ১২ টার পর পঞ্চমুন্ডির আসন প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ করতে হয়। বিশ্বনাথ হাজরা এক একটি মাথার উপর বসে টানা ৪৫ দিন ব্রহ্মচর্য ,ও হবিষ্যান্ন পালন ওগ্ৰহণ করে গুরুদেবের দেওয়া মন্ত্র জপ করেন।একই ভাবে ৫ টি মাথার উপর আলাদা আলাদা করে (৪৫x ৫ ) ২২৫ দিন ধরে কঠোর ভাবে সাধনা,ব্রহ্মচর্য পালন ও হবিষ্যান্ন গ্ৰহণ করে পাঁচটি মাথার উপর বসে সাধনা করার পর মাথাগুলির মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে।এরপর তাঁর চিহ্নিত বট গাছের নীচে তিন ফুট চওড়া গর্ত করে ঐ গর্তের মধ্যে চারকোণে চারটি অর্থাৎ ঈশান,বায়ু,অগ্নি ,নৈরিত কোণে চারটি প্রাণীর মাথা এবং মাঝখানে চন্ডালের মাথা প্রতিস্থাপন করে শ্বেত মাকাল,শ্বেত লজ্জাবতী,চুমুর,সিংহ পুচ্ছ গাছের শিকড়-আতর অগুরু,চন্দন,কুমকুম,তেল,লালবস্ত্র,ও কারণ নিয়ে লালবস্ত্রের উপর চারটি কোণে চারটি মাথিএবং মাঝখানে নির্দিষ্ট মাথা প্রতিস্থাপন করে অগুরু, কুমকুম,অষ্টগন্ধা,শ্বেতচন্দন,রক্তচন্দন, হলুদ চন্দন,চামেলি তেল,জবা কুসুম তেল, সিঁদুর ও কস্তুরী দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে অভিষেক করে পাথর চাপা দিয়ে ঐ পঞ্চমুন্ডির আসনের সামনে টানা নয় দিন নয় রাত্রী পূজা অর্চনা করে নয়দিন পর গুরুদেবের আদেশ নিয়ে অমাবস্যা তিথিতে রাত ১২ টার পর পঞ্চমুন্ডির আসনের প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ করে আসনে বসেন সাধনায় সিদ্ধলাভ করার জন্য। সাধনায় সিদ্ধলাভ করেন বিশ্বনাথ হাজরা।এরপর বিশ্বনাথ হাজরা এই জঙ্গলকে সাধনক্ষেত্র করে তারামা কে প্রতিষ্ঠা করে সাধনায় রত হন।জঙ্গল কেটে তৈরী করেন তারামা মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির। বটবৃক্ষের তলায় পঞ্চমুন্ডির আসন তৈরী করে মন্ত্রপূত ত্রিশূলের সামনে তন্ত্র-সাধনায় বসতেন।পদ্মপাতায় মায়ের ভোগ খাওয়াতেন। তাঁর মৃত্যুর পর আস্তে আস্তে ঐ স্থানটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।কেহ মারা গেলে সামান্য জঙ্গল কেটে দাহ করা হতো।

কুরিট,বড়মহড়া,ছোটমহড়া,মল্লগ্ৰাম
চাকপোতা,খোশালপুর,কোটালপাড়া,সহ বেশ কিছু গ্ৰাম কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। এই গ্ৰামগুলি পাশের ডি -২ ক্যানেলের জল সেচ কাজে লাগিয়ে চাষাবাদ করত। একটা সময়ে ক্যানেলের জল শুকিয়ে যায়। এলাকার মানুষ সমস্যায় পড়ে।গ্ৰামগুলিতে হা হা কার পড়ে। এই অবস্থার সৃষ্টি হয় আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে। এই সমস্যার সমাধানে র জন্য বড় বড় পুরোহিত,তান্ত্রিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।তারা পুরাণ ঘেঁটে কাত্যায়নী দশভূজা কাত্যায়নী দুর্গাপূজার আরাধনা করার বিধান দেন। আশ্রমটি শশ্নানে হওয়ায় ঐ স্থানে অসময়ে কাত্যায়নী দশভূজা দূর্গাপূজা করতে কোন পুরোহিত রাজী হয় নি। অবশেষে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে পূজা করতে রাজি হন, এবং কাত্যায়নী তন্ত্রমতে পূজা করেন। বর্তমানে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী প্রয়াত। প্রথমে এই পূজার সমস্ত ব্যয়ভার আমি (উত্তম কোলে) বহন করতাম। তারপর আমার সাধ্য না থাকায় বেশ কয়েক বৎসর পূজা বন্ধ থাকে।১৯৯৫ সালে শ্রীকান্ত কোলে, সুকুমার খাঁড়া,লক্ষীকান্ত কোলে গ্ৰামবাসীবৃন্দ পূজা করার জন্য এগিয়ে আসেন।
অষ্ট পাল ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রতিমা নির্মাণ করেচলেছেন।পূজায় মন্ত্রপাঠ করেন মদন হালদার, ধনঞ্জয় চক্রবর্তী,ভুজঙ্গ চক্রবর্তী,অমিত চক্রবর্তী।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *