May 18, 2024 | Saturday | 3:41 PM

ভারতের জাতীয় পতাকার বিবর্তনের ইতিহাস ও অবহেলিত গবেষকের কাহিনি

0

TODAYS বাংলা: ভারতের জাতীয় পতাকার প্রথম প্রবর্তন হয়েছিল ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে, এবং সেই সময়তেই এই পতাকাকে জাতীয় পতাকার রূপ দান করা হয়েছিল। এই পতাকা সৃষ্টির পর থেকেই ভারতবাসীর জাতীয় চেতনা জাগ্রত হতে শুরু করেছিল। পতাকাটি ছিল সাদা, বর্গাকার এবং মাঝখানে ছিল রক্তিম সূর্য।এই পতাকাটি একজন বাঙালি, বর্তমান পাকিস্তানের লাহোর নিবাসী গিরিশচন্দ্র বসু কর্তৃক রূপদান করা হয়েছিল। (চিত্র 1) এরপর মোট ১৭ বার বিবর্তনের মাধ্যমে আমরা ভারতের বর্তমান পতাকাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে পেয়েছি।

ভারতবর্ষের এই পতাকার ইতিহাস যার গবেষণার মাধ্যমে ভারতবাসী জানতে পারছেন তিনি হলেন আসানসোলের একজন শিক্ষক কালিশঙ্কর ভট্টাচার্য মহাশয়। তিনি প্রথম সারাজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও গবেষণায় ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকার বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন এবং ভারত সরকার তাঁর গবেষণাকে স্বীকৃতি প্রদান করেন।

এবার আমরা ভারতবর্ষের পতাকা বিবর্তনের মূল কিছু অংশ আলোচনা করছি।

১)১৯০৫ সালে প্রমথনাথ মিত্র যিনি অনুশীলন সমিতির সভাপতি ছিলেন তিনি বঙ্গভঙ্গের সময় ১৯০৫ সালের ৭ই আগস্ট জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। এই পতাকার তিনটি বর্ণের উপরের অংশে ছিল লাল, মধ্যবর্তী পর্যায়ে ছিল হলুদ এবং নিচে সবুজ বর্ন ছিল। লালের মধ্যে আটটি পুষ্প, মধ্যের হলুদ অংশে সংস্কৃতে বন্দেমাতারাম এবং নিচের সবুজ অংশে চন্দ্র ও সূর্যের চিত্র ছিল।(চিত্র ২) (তথ্য আনন্দবাজারের এবেলা কর্তৃক সংগৃহী
এরপর ক্রমপর্যায়ে চারটি বিবর্তনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা স্বদেশী আন্দোলনের মুখ্য অংশ হয়ে ওঠে। বর্ণের মধ্যে ওপরে লাল, মাঝে গেরুয়া এবং নীল বর্ণ স্থান পায়। উপরের লাল অংশে আটটি পদ্ম, মধ্যে বাংলায় বন্দেমাতারাম এবং নিম্নে সূর্য ও অর্ধচন্দ্র স্থান পায়। সম্ভবত মেদিনীপুরের স্বদেশী আন্দোলনকারীরা এই জাতীয় পতাকা নির্মাণ করেছিলেন। (চিত্র 3)

এরপর ১৯০৬ সালে বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’ লালবর্ণের পতাকা নির্মাণ করেন। ঋষি অরবিন্দের ভাই বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এই পতাকাটি প্রস্তাবিত করেছিলেন। এই পতাকাটি মূলত আধ্যাত্মবাদকে প্রচার করেছিল। পতাকাটির বর্ণ ছিল লাল এবং তাতে রুদ্র শিবের ত্রিশূল, একটি তরবারি এবং নিজে চক্র ছিল। (চিত্র 4)

এরপর ১৯০৭ সালে ২২শে আগস্ট ভারতের মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামী মাদাম কামা জার্মানিতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারতের পতাকা উত্তোলন করে তাকে আন্তর্জাতিক মাত্রা প্রদান করেছিলেন। এই পতাকার উপরাংশে গেরুয়া, মাঝে হলুদ নিচে সবুজ বর্ণ ছিল। মধ্যবর্তী অংশে বন্দেমাতারাম, নিম্নে সূর্য ও চন্দ্র ছিল (চিত্র 5)।
এরপর ভগিনী নিবেদিতা ১৯০৯ সালে একটি লাল বর্ণের পতাকার প্রস্তাবনা করেছিলেন। এই পতাকার মধ্যে ছিল বজ্রকুসুম ও দন্ড। এই পতাকার মধ্যে দিয়েও বিশ্ববাসীর কাছে ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ এর প্রসার ঘটেছিল।

এরপর ১৯১৬ সালে হেমরুল আন্দোলনের পর জাতীয় কংগ্রেস মনে করলেন যে ভারতবর্ষের জন্য একটি সঠিক পতাকা নির্মাণ করা প্রয়োজন।তারা অ্যানি বেসান্ত নেতৃত্বে পাঁচটি লাল এবং চারটি সবুজ স্ট্রাইপ করা একটি পতাকা নির্মাণ করেন এবং তাতে হিন্দুদের পবিত্র সপ্তর্ষিমণ্ডলের প্রতীকরূপে সাদা তাঁরা বসানো হয়েছিল। (চিত্র 7)।

এরপর ১৯২২ সালে গান্ধীজী বিদেশি বস্ত্র বর্জন এবং চরকায় সুতো কাটার ইতিহাসকে নিয়ে দুটি বর্ণের পতাকা নির্মাণ করেন। এর ওপরে ছিল লাল এবং নিচে ছিল সবুজ। মধ্যবর্তী অংশে একটি চরকার ছবি ছিল। এখানে লাল বর্ণ হিন্দু ধর্ম এবং সবুজ বর্ণ মুসলিম সম্প্রদায় কি উদ্দীপিত করেছিল।(চিত্র 8. )

কালিশংকর বাবুর মতে এই পতাকা ১৯২২-১৯৩০ প্রায় আট বছর ভারতের জাতীয় পতাকা ছিল। এরপর ১৯৩১ সালে অন্ধপ্রদেশের পিঙ্গলি ভেঙ্কাইয়া , একটি পতাকার প্রস্তাবনা করেন, যার উপরাংশে ছিল গেরুয়া, মধ্যে সাদা এবং নিম্নে সবুজ। মধ্যবর্তী সাদা অংশে ভারতের সংস্কৃতির প্রতীক চরকা স্থান পেয়েছিল। (চিত্র 9)

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ১৯৪৩ সালে প্রথম আন্দামানের Port Blair- এ স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন । এই পতাকা টি ছিল ত্রীবর্ণ। এর গৈরিক অংশে Azad এবং সবুজ অংশে HIND এবং মধ্যবর্তী অংশে বীরত্বের প্রতীক বাঘের ছবি ছিল ।(চিত্র ১০)

এইভাবে মোট ১৭ বার বিবর্তনের পর ১৯৪৭ সালের ২৩ জুন ভারতের গণপরিষদ জাতীয় পতাকার জন্য একটি কমিটি গঠন করে। ভারতের রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ এর নেতৃত্বে মৌলানা আবদুল কালাম আজাদ, সরোজিনী নাইডু, বি আর আম্বেদকর এবং চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী সম্মিলিত ভাবে, ১৯৪৭ সালের ২২শে জুলাই, গেরুয়া, সাদা এবং সবুজ এই তেরঙ্গা পতাকাকেই ভারতের পতাকা হিসেবে নির্দিষ্ট করেন।
১৯৪৭ সালের ২২শে আগস্ট ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক চরকার পরিবর্তে সারনাথের অশোকচক্র টিকে স্থান দেওয়া হয়।

এই পতাকার গেরুয়া বর্ণ ত্যাগ, বৈরাগ্য ও সাহসিকতার প্রতীক নির্ণয় করে।
মাঝের সাদা অংশ শান্তি, পবিত্রতা ও সত্যের প্রতীক নির্ণয় করে। নিজের সবুজ বর্ণ জীবনধর্ম, নির্ভীকতা, বিশ্বাস ও প্রাণ-প্রাচুর্যে্য ইঙ্গিত বহন করে।

মধ্যবর্তী অংশ নীল বর্ণের ২৪ টি ডন্ড যুক্ত অশোক চক্র ন্যায়, ধর্ম, উন্নতি, প্রগতির নির্দেশ করে।

আমরা সাধারণত কোনো পাঠ্যপুস্তকে বা কোনো গ্রন্থে ভারতের জাতীয় পতাকা বিবর্তনের ইতিহাস খুঁজে পাই না। আসানসোলের মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষক কালিশঙ্কর বাবুর দীর্ঘদিনের নিরলস গবেষণা থেকে আমরা এই বিবর্তনের ইতিহাস জানতে পারি।বছর পাঁচেক আগে কালিশংকর বাবুর বাড়িতে একটি ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে তিনি বিভিন্ন দেশের পতাকা এবং আমাদের তেরঙ্গারও আরো বহু তথ্য আমাকে দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় তিনি অত্যন্ত কষ্ট করে স্নাতক হয়েছিলেন। তাঁর এই দীর্ঘ গবেষণার জন্য ২০১০ সালে রাজ্যপাল তাকে ডক্টরেট প্রদান করেন।কিন্তু দুঃখের বিষয় এই বৃদ্ধ মানুষটির সারা জীবনের গবেষণার ফলস্বরুপ পাননি কোনো সরকারি সম্মান। স্বাধীনতা দিবসে তিনি আড়াল থেকে পতাকা উত্তোলন করেন পরিবার ও দু-একটি বাচ্চার সাথে। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য হল এই নিরলস গবেষণাকারী মানুষটির নাম সবাইকে জানানো এবং তার ওপর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা।।
সুরথ চক্রবর্ত্তী

Advertise

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *