May 19, 2024 | Sunday | 3:34 PM

মুর্শিদাবাদ ঘুরতে যাবেন ? জেনে নিন কোথায় থাকবেন কি করবেন ?

0

অর্পিতা মাইতি

TODAYS বাংলাঃ ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে পড়া বাংলার ইতিহাসের কথা বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি করে কোন্‌ জায়গাটার কথা মনে পড়ে ? (আমার এই প্রশ্নের উত্তর ‘মুর্শিদাবাদ’ই হবে যেহেতু এই লেখা ‘মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ’ সম্পর্কে । তা নাহলে গৌড়, নদীয়া, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর – এসবও হতে পারত !) হ্যাঁ, মুর্শিদাবাদ । মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে নবাব সিরাজ-উদ্‌-দৌলা পর্যন্ত বাংলার নবাবদের স্মৃতি যেখানে জড়িয়ে আছে, তাঁদের ব্যবহৃত সরঞ্জাম আর জীবনযাপনের ইয়ে যেখানে ছড়িয়ে আছে – সেই মুর্শিদাবাদ । নবাব পরবর্তী যুগের হাজারদুয়ারি যেখানে আছে – সেই মুর্শিদাবাদ । ইতিহাস যেখানে জীবন্ত হয়ে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মতো চলতে থাকে – সেই মুর্শিদাবাদ ।

মুর্শিদাবাদ স্টেশন
২০১৩ সালটা ইতিহাস হয়ে যাওয়ার কয়েকমূহুর্ত আগে আমাদের যাত্রা শুরু হল এই ঐতিহাসিক জায়গার উদ্দেশ্যে । ৩১শে ডিসেম্বর সকাল ৬:৫০ এ কলকাতা স্টেশন থেকে হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেসে আমরা মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । এবারে আমাদের দল আটজনের – আমি আমার স্ত্রী, বাবা, মা ছাড়া আমার স্ত্রীর কলিগ নন্দিনীদি, দীপঙ্করদা আর ওঁদের যমজ ছেলে সায়ক ও সৌনক । (নন্‌-আইডেন্টিক্যাল ট্যুইন্স) পৌঁছনোর নির্ধারিত সময় বেলা ১১:১৮ হলেও আমরা পৌঁছলাম দুপুর দেড়টায় । এর কারণ হল ঐদিন সকালের লালগোলা প্যাসেঞ্জার বাতিল থাকায় আমাদের ট্রেনটা রাণাঘাটের পর থেকে অল্‌ স্টপ্‌ হয়ে গেল (পরে অবশ্য জেনেছিলাম এটা শুধু ঐদিন হয়েছে এমন নয়, এই ব্যাপারটা ওই লাইনের প্রায় রোজকার ঘটনা) ।

যে টাঙ্গা আমরা চড়েছি
মুর্শিদাবাদ স্টেশনটা খুব সুন্দর দেখতে – হাজারদুয়ারীর আদলে তৈরি করা । স্টেশন থেকে আমাদের ‘হোটেল মঞ্জুষা’ প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে, তাই টাঙ্গা নেওয়া হল । আটজনের জন্য দু’টো টাঙ্গা । এই টাঙ্গায় চড়াটা আমার মনে হয় সবার কাছেই বেশ উপভোগ্য আর এই সুযোগ খুব বেশি জায়গায় পাওয়াও যায় না । পিচের রাস্তার ওপর দিয়ে ঘোড়ার ‘খুট্‌ খুট্‌’ শব্দ তুলে এগিয়ে চলা আর তার সঙ্গে সহিসের মাঝে মাঝে ছড়ি দিয়ে ঘোড়াকে আল্‌তো করে মারা আদর করা – সবমিলিয়ে ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে । আমাদের হোটেল হাজারদুয়ারির একেবারে সামনে গঙ্গার পাশে, তাই হোটেলে পৌঁছনোর পথে টুক্‌ করে একবার হাজারদুয়ারি দেখা হয়ে গেল । টাঙ্গাওয়ালারা আমাদের থেকে মাথাপিছু ১০ টাকা করে নিল ।

আমাদের ঘর থেকে গঙ্গার দৃশ্য
‘হোটেল মঞ্জুষা’ মুর্শিদাবাদের ভালো হোটেলগুলোর একটা । ডিসেম্বর-জানুয়ারি হচ্ছে মুর্শিদাবাদের যাকে বলে ‘পীক্‌ সিজন্‌’ কাজেই আগে থেকে বুক করে না এলে ঘর পাওয়া অসম্ভব, অন্ততঃ মঞ্জুষার মতো হোটেলে । আমরা দো’তলায় তিনটে ঘর নিয়েছিলাম যার ভাড়া ৮০০ টাকা/প্রতিদিন । (আমাদের একটু চেনা থাকায় ৫০ টাকা করে ছাড় পেয়েছি) ঘর যে খুব কিছু ভালো তা নয়, আয়তনে বেশ ছোট । ঘরে খাট, টিভি, একটা টেবিল, দু’টো চেয়ার আর সেইসঙ্গে অ্যাটাচ্‌ড বাথ সবই আছে কিন্তু যেটা প্রায় নেই সেটা হল হাঁটাচলার জায়গা । কিন্তু আগেই বলেছি, এর থেকে ভালো হোটেল মুর্শিদাবাদে বিশেষ পাওয়া যাবে না, পয়সা ফেললেও না । তবে প্রত্যেকটা ঘরের সঙ্গে একটা করে সুন্দর বারান্দা আছে, আমাদের তিনটে ঘরের মধ্যে দু’টো গঙ্গার দিকে । সেদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই সুন্দর ।

আমরা দুপুরে খেয়ে নিলাম । এখানে ভাত মিল্‌ সিস্টেমে – ভাত ডাল ভাজা তরকারি আর সেইসঙ্গে মাছ বা মাংস । আমাদের সবমিলিয়ে পড়ল মোট ৯৪০ টাকা ।

এরপর আমরা হোটেলে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নিলাম আমরা কবে কোথায় ঘুরব । আমরা ফিরে যাব পরশুদিন দুপুরের ট্রেনে, তাই আমাদের হাতে আজ বিকেল, কাল সারাদিন আর পরশু সকাল । এর মধ্যে আগামীকাল ১লা জানুয়ারি এবং এইদিন হাজারদুয়ারি তথা মুর্শিদাবাদে প্রচন্ড ভীড় হয় । তাই ঠিক হল আমরা আগামীকাল গঙ্গার ও’পারের মুর্শিদাবাদ ঘুরব আর পরশুদিন সকালে এ’পারের মুর্শিদাবাদ ঘুরব । তাহলে আজ বিকেলে আমরা কি করব ? প্রকৃতিকে দেখবো !

হোটেল মঞ্জুষার বাগান
এ’বার সেই বিশেষ ব্যাপারটার সম্পর্কে লিখি । হোটেল মঞ্জুষার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এর বাগান ।হোটেলের চারদিকে নানারকম গাছ লাগিয়ে একটা অসাধারণ বাগান তৈরি করা হয়েছে । আর এর সম্পূর্ণ কৃতিত্বই হল ম্যানেজার মৃদুল সরকার-এর । (এই প্রথম আমার লেখায় কোনও হোটেলের ম্যানেজারের নাম লিখলাম – এর থেকে বোঝা যাবে ভদ্রলোক কতটা বিশিষ্ট) আমাদের পরিচিত প্রায় সব গাছ উনি লাগিয়েছেন তো বটেই, সেইসঙ্গে এমন কিছু গাছ লাগিয়েছেন যেগুলো আমরা যারা শহরে থাকি তারা শুধু নামই শুনেছি, কোনওদিন চোখে দেখিনি । এমনকি এরকম গাছও ওনার বাগানে আছে যেগুলো প্রকৃতপক্ষে সমতলের গাছই নয়, পার্বত্য অঞ্চলের গাছ ! শুধুমাত্র মৃদুলবাবুর আদর আর যত্নে এরা এই পরিবেশে সবার সঙ্গে একসঙ্গে যে শুধু বেঁচেই আছে তাই নয়, দিব্যি ফুল-ফল ফলাচ্ছে । সব দেখে অরণ্যদেবের নন্দনকাননের কথা মনে পড়ে যায় যেখানে বিভিন্নধরনের প্রাণীরা সহাবস্থান করে।

মৃদুল সরকারের নন্দন কাননের ফুল
আমি এখানে কোনও গাছের নাম আলাদা করে লিখছি না, কারণ ওনার বাগানের সব গাছই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, স্ব-স্ব মহিমায় বিদ্যমান, তাই কয়েকটা নাম লিখলে আমার মতে বাকিদের প্রতি অবিচার করা হবে আর সবার নাম এখানে লেখা সম্ভব নয় । এখানে শুধু একটা বিশেষ গাছেরই উল্লেখ করছি (আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লেখার অভ্যেস আছে শুনে মৃদুলবাবু আমাকে বারবার সেই গাছের ব্যাপারে উল্লেখ করতে বারণ করেছেন, তাই নামটা আর লিখলাম না) যে গাছ ওনার বাগানে তিন-চারটে আছে । এই গাছ যে শুধু দুষ্প্রাপ্য তাই নয়, দুর্মূল্যও । মৃদুলবাবু সবাইকে এই গাছ দেখান না, আমাদের গাছের সম্পর্কে আগ্রহ আছে বলে দেখালেন ।

মঞ্জুষার বাগান থেকে গঙ্গার ওপারে সূর্য্যাস্ত
বাগান দেখা শেষ হলে আমরা গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলাম । এই বসার জায়গাও হোটেল মঞ্জুষার নিজস্ব । এখানে আমরা বসে বসে সূর্য্যাস্ত দেখলাম । তারপর ঘরে এসে সন্ধ্যেবেলা চা-টা খেয়ে একটু হাঁটতে বেরোলাম । মৃদুলবাবুর দৌলতে এই সান্ধ্যভ্রমণে আমাদের আরও একটা জায়গা দেখা হয়ে গেল কিন্তু সেটার কথাও ওনার অনুরোধেই আর লিখছি না । শুধু এ’টুকু বলে রাখি মুর্শিদাবাদে এসে এই জায়গাটা দেখার সুযোগ প্রায় কেউই পায় না, আমরা মৃদুলবাবুর সৌজন্যেই পেয়েছি, যিনি ওখানকার একজন বেশ ‘ইনফ্লুয়েন্সিয়াল’ লোক । হোটেল মঞ্জুষায় উঠে মৃদুল সরকারের সঙ্গে ভাব জমাতে পারলে উনি এই সুযোগ করে দিলেও দিতে পারেন !

Advertise

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *